সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ডাইরী থেকে তার লেখা: পর্ব - ২

এম ফয়জুল্লাহ || রাজনীতি টেলিভিশন, চট্টগ্রাম

যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করলাম....(পর্ব ২)
--------------------------------

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবের ঘোষণা আমাদের কাছে গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে হলো। আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙালি ও পাকিস্তানী সৈনিকদের মাঝেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠছিল। ১৩ মার্চ হলো শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ইয়াহিয়ার আলোচনা। আমরা সবাই ক্ষণিকের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আশা করলাম, পাকিস্তানী নেতারা যুক্তি মানবে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানীদের সামরিক প্রস্তুতি হ্রাস না পেয়ে দিনদিনই বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো।
প্রতিদিনই পাকিস্তান থেকে সৈন্য আমদানি করা হলো। বিভিন্ন স্থানে জমা হতে থাকলো অস্ত্র-শস্ত্র আর গোলাবারুদ। সিনিয়র পাকিস্তানী সামরিক অফিসাররা সন্দেহজনকভাবে বিভিন্ন গ্যারিসনে আসা-যাওয়া শুরু করলো। চট্টগ্রামে নৌ-বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করা হলো। ১৭ মার্চ স্টেডিয়াম ই বি আর সি’র লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ আর চৌধুরী, আমি চূড়ান্ত যুক্ত-পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম। লেঃ কর্নেল চৌধুরীকে অনুরোধ করলাম নেতৃত্ব দিতে। দু’দিন পর ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন (এখন মেজর) রফিক আমার বাসায় গেলেন এবং ইপিআর বাহিনীকে সঙ্গে নেবার প্রস্তাব দিলেন। আমরা ইপিআর বাহিনীকে আমাদের পরিকল্পনাভুক্ত করলাম। এর মধ্যে পাকিস্তানী বাহিনীও সামরিক তৎপরতা শুরু করারচূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। ২১ মার্চ জেনারেল আবদুল হামিদ খান গেল চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্টে। চট্টগ্রামে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রণয়নই তার এই সফরের উদ্দেশ্য। সেদিন রেজিমেন্ট সেন্টারে ভোজসভায় জেনারেল হামিদ ২০তম বালুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফাতেমীকে বললো, “ফাতেমী, সংক্ষেপে,ক্ষিপ্রগতিতে আর যত কম সম্ভব লোকক্ষয় করে কাজ করতে হবে।” আমি এ কথাগুলো শুনেছিলাম। ২৪ মার্চ ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ঢাকা চলে এলেন। সন্ধ্যায় পাকিস্তানী বাহিনী শক্তি প্রয়োগে চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথ করে নিল। জাহাজ ‘সোয়াত’ থেকে অস্ত্র নামানোর জন্যেই বন্দরের দিকে ছিল তাদের এই অভিযান। পথে জনতার সাথে ঘটলো তাদের কয়েক দফা সংঘাত। এতে নিহত হলো বিপুল সংখ্যক বাঙালি। সশস্ত্র সংগ্রাম যে কোন মুহূর্তেই শুরু হতে পারে, এ আমরা ধরেই নিয়েছিলাম। মানসিক দিক দিয়ে আমরা ছিলাম প্রস্তুত। পরদিন আমরা পথের ব্যারিকেড অপসারণের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তারপর এলো সেই কালোরাত ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী কালো রাত। রাত ১ টায় আমার কমান্ডিং অফিসার আমাকে নির্দেশ দিলো নৌবাহিনীর ট্রাকে করে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে জেনারেল আনসারির কাছে রিপোর্ট করতে। আমার সাথে নৌবাহিনীর (পাকিস্তানী) প্রহরী থাকবে তাও জানানো হলো। আমি ইচ্ছা করলে আমার সাথে তিনজন অফিসারও থাকবে। অবশ্য কমান্ডিং অফিসাররের মতে, সে যাবে আমাকে গার্ড দিতে। এ আদেশ পালন করা আমার পক্ষে ছিল অসম্ভব। আমি বন্দরে যাচ্ছি কি না তা দেখার জন্য লোক ছিল। আর
বন্দরের (সশরীর) প্রতীক্ষায় ছিল জেনারেল আনসারি। হয়তো বা আমাকে চিরকালের মতোই স্বাগত জানাতে। আমরা বন্দরের পথে বেরুলাম। আগ্রাবাদে আমাদের থামতে হলো। পথে ছিল ব্যারিকেড। সেই সময়ে সেখানে এলো মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী, ক্যাপ্টেন অলি আহমদের কাছ থেকে এক বার্তা নিয়ে এসেছে। আমি রাস্তায় হাঁটছিলাম।। খালেক আমাকে একটু দূরে নিয়ে গেল। কানে কানে বললো ‘তারা ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে। বহু বাঙালিকে ওরা হত্যা করেছে।” এটা ছিল একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত সময়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি বললাম, “আমরা বিদ্রোহ করলাম। তুমি ষোলশহর বাজারে যাও। পাকিস্তানী অফিসারদের গ্রেফতার করো। অলি আহমদকে বলো ব্যাটেলিয়ন তৈরি রাখতে, আমি আসছি।” আমি নৌবাহিনীর ট্রাকের কাছে ফিরে এলাম। পাকিস্তানী অফিসার, নৌবাহিনীর চীফ অফিসার ও ড্রাইভারকে জানালাম যে আমাদের আর বন্দরে যাওয়ার দরকার নেই। আমি নৌবাহিনীর ট্রাকের কাছে ফিরে এলাম। এতে তাদের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না দেখে আমি পাঞ্জাবী ড্রাইভারকে ট্রাক ঘুরাতে বলালম। ভাগ্য ভালো বলব, সে আমার আদেশ মানলো। আমরা আবার ফিরে চললাম। ষোলশহর বাজারে পৌঁছেই আমি গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে একটা রাইফেল তুলে নিলাম। পাকিস্তানী অফিসারটির দিকে তাক করে তাকে বলালম, “হাত তোল। আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম।” সে আমার কথা মানলো। নৌবাহিনীর লোকেরা এতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো, পর মুহূর্তেই আমি নৌবাহিনীর অফিসারদের দিকে রাইফেল তাক করলাম। তারা ছিল আটজন। সবাই আমার নির্দেশ মানলো এবং অস্ত্র ফেলে দিল। আমি কমান্ডিং অফিসারের জীপ নিয়ে তার বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। আর বাসায় পৌঁছে হাত রাখলাম কলিং বেলে। কমান্ডিং অফিসার পাজামা পরেই বেরিয়ে এলো, খুলে দিল দরজা। ক্ষিপ্রগতিতে আমি ঘরে ঢুকে পড়লাম এবং গলা শুদ্ধ তার কলার টেনে ধরলাম। দ্রুত গতিতে আবার দরজা খুলে কর্নেলকে আমি বাইরে আনলাম। বললাম, “বন্দরে পাঠিয়ে আমাকে মারতে চেয়েছিলে? আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম। এখন লক্ষ্মী সোনার মতো আমার সঙ্গে এস।” সে আমার কথা মানলো, আমি তাকে ব্যাটেলিয়নে নিয়ে এলাম। অফিসারদের মেসে যাওয়ার পথে আমি কর্নেল শওকতকে (তখন মেজর) ডাকলাম। জানালাম, সমস্ত পাকিস্তানী অফিসারকে কী করে রাখা হয়েছে। আমি অফিসে গেলাম। সবচেষ্টা ব্যর্থ হলো। তারপর রিং করলাম বেসামরিক বিভাগে টেলিফোন অপারেটরকে। তাকে অনুরোধ জানালাম- ‘ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট, কমিশনার, ডিআইজি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটেলিয়ন বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে তারা। এদের সাথে আমি টেলিফোন যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু কাউকে পাইনি। তারা অনুরোধ রক্ষা করতে রাজী হলো। সময় ছিল অতি মূল্যবান। আমি ব্যাটেলিয়নের অফিসার, জেসিও আর জোয়ানদের ডাকলাম এবং তাদের নির্দেশ দিলাম সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। তারা সর্বসম্মতিক্রমে হৃষ্টচিত্তে এ আদেশ মেনে নিলো। আমি তাদের একটা সামরিক পরিকল্পনা দিলাম। তখন রাত ২টা বেজে ১৫ মিনিট, ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সাল। রক্তের আঁখরে বাঙালির হৃদয়ে লেখা একটি ক্ষণ। বাংলাদেশের জনগণ চিরদিন স্মরণ রাখতে ভালোবাসবে। এই ক্ষণটিকে তারা কোনদিন ভুলবে না। (সমাপ্ত)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এর জীবনী

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ( ১৩ মার্চ ১৯৪৯ - ২২ নভেম্বর ২০১৫); যিনি সাকা চৌধুরী নামেও পরিচিত; ছিলেন একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ এবং জাতীয় সংসদের চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে ছয় বার নি...

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ডাইরী থেকে তার লেখা পর্ব - ১

এম ফয়জুল্লাহ || রাজনীতি টেলিভিশন , চট্টগ্রাম যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করলাম.... (পর্ব ১) -------------------------------- ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে আমাকে নিয়োগ করা হলো জয়দেবপুরে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে...