সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ডাইরী থেকে তার লেখা পর্ব - ১

এম ফয়জুল্লাহ || রাজনীতি টেলিভিশন, চট্টগ্রাম

যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করলাম.... (পর্ব ১)
--------------------------------

১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে আমাকে নিয়োগ করা হলো জয়দেবপুরে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়নে আমি ছিলাম সেখানে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড অফিসার কমান্ডিং লেঃ কর্নেল আবদুল কাইয়ুম ছিল একজন সাহসী পাকিস্তানী। একদিন ময়মনসিংহের এক ভোজসভায় ধমকের সুরে সে ঘোষণা করলো- বাংলাদেশের জনগণ যদি সদাচরণ না করে তাহলে সামরিক আইনের সত্যিকার ও
নির্মম বিকাশ এখানে ঘটানো হবে। আর তাতে হবে প্রচুর রক্তপাত। এই ভোজসভায় কয়েকজন বেসামরিক ভদ্রলোকও উপস্থিত ছিলেন। তাদের মাঝে ছিলেন ময়মনসিংহের তদানীন্তন ডেপুটি কমিশনার জনাব মোকাম্মেল।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাইয়ুমের এই দম্ভোক্তি আমাদের বিস্মিত করলো। এর আগেও কাইয়ুম এক গুরুত্বপুর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিল। ইসলামাবাদে পাকিস্তানী নীতি নির্ধারকের সাথে সংযোগ ছিল তার। তার মুখে পুরানো প্রভুদের মনের কথাই ভাষা পেয়েছে কিন্তু, তাই আমি ভাবছিলাম। পরবর্তী সময়ে এ ব্যাপারে আমি অনেকগুলো প্রশ্ন করি এবং এর কোনো কথা থেকে আমার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে সে যা বলেছে, তা জেনেশুনেই বলেছে। উপযুক্ত সময়ে কার্যকরী করার জন্য সামরিক ব্যবস্থার এক পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। আর কাইয়ুম সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আমি এতে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ি। এই সময়ে আমি একদিন চতুর্দশ ডিভিশন সদর দফতরে যাই। জিএসও-১ (গোয়েন্দা) লেঃ কর্নেল তাজ আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কয়েকজন সম্পর্কে আমার কাছে অনেক কিছু জানতে চায়। আমি তার এসব তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করি। সে আমাকে জানায় যে, তারা বাঙালি নেতাদের জীবনী সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে। আমি বারবার তাকে জিজ্ঞেস করি- এসব খুঁটিনাটির প্রয়োজন কি? এই প্রশ্নের জবাবে সে জানায়- ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিধারায় এগুলো কাজে লাগবে। গতিক যে বেশি সুবিধার নয়, তার সাথে আলোচনা করেই আমি তা বুঝতে পারি। সেই বছরেই সেপ্টেম্বর মাসে চার মাসের জন্য আমি পশ্চিম জার্মানী যাই। এ সময়ে বাংলাদেশের সর্বত্র এক রাজনৈতিক বিক্ষোভ-ঝড় বয়ে যায়। পশ্চিম জার্মানীতে অবস্থানকালে আমি একদিন দেখি, সামরিক এ্যাটাচি কর্নেল জুলফিকার সে সময়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কারিগরি এ্যাটাচির সাথে কথা বলছিল। এই ব্যক্তিটি ছিল এক সরলমনা পাঠান অফিসার। তাদের সামনে ছিল করাচীর দৈনিক পত্রিকা ডন-এর একটা সংখ্যা। এতে প্রকাশিত হয়েছিল ইয়াহিয়ার ঘোষণা- ১৯৭০ সালেই নির্বাচন হবে। সরলমনা পাঠান অফিসারটি বলছিল, “নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ব্যাপকভাবে নির্বাচনে জয়ী হবে, আর সেখানেই পাকিস্তানের পরিসমাপ্তি।” এর জবাবে কর্নেল জুলফিকার বললো, “আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সংখ্যাগিরষ্ঠতা লাভ করতে পারে কিন্তু কেন্দ্রে সে ক্ষমতা পাবে না। কেননা অন্যান্য দল মিলে কেন্দ্রে আওয়ামী লীগকে ছাড়িয়ে যাবে। আমি এটা জেনে বলছি। এ সম্পর্কে আমার কাছে বিশেষ খবর আছে।”
এরপর আমি বাংলাদেশে ফিরে এলাম। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে আমাকে নিয়োগ করা হলো চট্টগ্রামে। এবার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটেলিয়নের সেকেন্ড-ইন- কমান্ড। এর কয়েকদিন পর আমাকে ঢাকা যেতে হয়। নির্বাচনের সময়টা আমি ছিলাম ক্যান্টনমেন্টে। প্রথম থেকেই পাকিস্তানী অফিসাররা মনে করতো চূড়ান্ত বিজয় তাদের হবে। কিন্তু নির্বাচনের দ্বিতীয় দিনে তাদের মুখে আমি দেখলাম হতাশার সুস্পষ্ট ছাপ। ঢাকায় অবস্থানকারী পাকিস্তানী সিনিয়র অফিসারদের মুখে দেখলাম আমি আতংকের ছবি। তাদের এ আতংকের কারণও আমার অজানা ছিল না। শিগগিরই জনগণ গণতন্ত্র ফিরে পাবে, এই আশায় আমরা বাঙালি অফিসাররা তখন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম। চট্টগ্রামে আমরা ব্যস্ত ছিলাম অষ্টম ব্যাটেলিয়নকে গড়ে তোলার কাজে। এটা ছিল রেজিমেন্টের তরুণতম ব্যাটেলিয়ন। এটার ঘাঁটি ছিল ষোলশহর বাজারে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে এই ব্যাটেলিয়নকে পাকিস্তানের
খারিয়ানে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এর জন্য আমাদের সেখানে পাঠাতে হয়েছিল দুশ’ জওয়ানের এক দ্রুতগামী দল। অন্যরা ছিল একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের সৈনিক। আমাদের তখন যেসব অস্ত্র-শস্ত্র দেয়া হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ৩শ’
পুরানো ০০৩ রাইফেলস, চারটা এলএমজি ও দুটি তিন ইঞ্চি মর্টার। গোলাবারুদের পরিমাণও ছিল নগণ্য। আমাদের এন্টিট্যাঙ্ক বা ভারি মেশিনগান ছিল না। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বাংলাদেশের যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠেছিল তখন আমি একদিন খবর পেলাম তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিহারীদের বাড়িতে বাস করতে শুরু করেছে। খবর নিয়ে আমি আরো জানলাম কমান্ডোরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-শস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে বিহারী বাড়িগুলোতে জমা করেছে এবং রাতের অকারে বিপুল সংখ্যায় তরুণ বিহারীদের সামরিক ট্রেনিং দিচ্ছে, এসব থেকে এরা যে ভয়ানক রকমের অশুভ একটা কিছু করবে তার সুস্পষ্ট আভাসই আমি পেলাম। তারপর এলো ১ মার্চ। এই সময়ে আমার ব্যাটেলিয়নের এনসিওরা আমাকে জানালো, “প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিংশতম বালুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা বেসামরিক পোশাক পরে ট্রাকে করে কোথায় যেন যায়। তারা ফিরে আসে আবার শেষ রাতের দিকে।” আমি উৎসুক হলাম, লোক লাগালাম খবর নিতে। খবর নিয়ে জানলাম প্রতি রাতেই তারা যায় কতগুলো নির্দিষ্ট বাঙালি পাড়ায়, নির্বিচারে হত্যা করে সেখানে বাঙালিদের। এই
সময় প্রতিদিন ছুরিকাহত বাঙালিদের হাসপাতালে ভর্তি হতেও শোনা যায়।
এই সময়ে আমাদের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জানজুয়া আমার গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখার জন্যে লোক লাগায়। মাঝে মাঝেই তার লোকেরা গিয়ে আমার সম্পর্কে খোঁজ- খবর নিতে শুরু করে। আমরা তখন আশংকা করছিলাম, আমাদের হয়তো নিরস্ত্র করা হবে। আমি আমার মনোভাব দমন করে কাজ করে যাওয়ার সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করি। বাঙালি হত্যা ও বাঙালি দোকানপাটে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ক্রমেই বাড়তে থাকে। আমাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা হলে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবো কর্নেল (তখন মেজর) শওকতও আমার কাছে তা জানতে চান। ক্যাপ্টেন শমসের মবিন এবং খালেকুজ্জামান আমাকে জানান যে, স্বাধীনতার জন্য আমি যদি অস্ত্র তুলে নেই তাহলে তারাও দেশের মুক্তির জন্য প্রাণ দিতে কুণ্ঠবোধ করবে না। ক্যাপ্টেন অলি আহমদ আমাদের মাঝে খবর আদান-প্রদান করতেন। জেসিও এবং এনসিওরাও দলে দলে বিভক্ত হয়ে আমার কাছে বিভিন্ন স্থানে জমা হতে থাকলো। তারাও আমাকে জানায় যে, কিছু একটা না হলে বাঙালি জাতি চিরদিনের জন্যে দাসে পরিণত হবে। আমি নীরবে তাদের কথা শুনতাম। কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম উপযুক্ত সময় এলেই আমি মুখ খুলবো। সম্ভবত ৪ মার্চে ক্যাপ্টেন অলি আহমদকে ডেকে নেই। আমাদের ছিল সেটা প্রথম বৈঠক। আমি তাকে সোজাসুজি বললাম, সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। ক্যাপ্টেন আহমদও আমার সাথে একমত হন। আমরা পরিকল্পনা করি এবং প্রতিদিন আলোচনা বৈঠকে মিলিত হতে শুরু করি। (চলবে)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এর জীবনী

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ( ১৩ মার্চ ১৯৪৯ - ২২ নভেম্বর ২০১৫); যিনি সাকা চৌধুরী নামেও পরিচিত; ছিলেন একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ এবং জাতীয় সংসদের চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে ছয় বার নি...

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ডাইরী থেকে তার লেখা: পর্ব - ২

এম ফয়জুল্লাহ || রাজনীতি টেলিভিশন , চট্টগ্রাম যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করলাম....(পর্ব ২) -------------------------------- ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবের ঘোষণা আমাদের কাছে গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে ...